আজকের বিষয় জীবন ও বৃক্ষ প্রবন্ধের মূলভাব জীবন ও বৃক্ষ প্রবন্ধের মূল বক্তব্য।
অথবা, ‘জীবন ও বৃক্ষ’ প্রবন্ধের বিষয়বস্তু/ভাববস্তু।
জীবন ও বৃক্ষ প্রবন্ধের মূলভাব
বিকশিত জীবনের প্রতি আগ্রহ জাগিয়ে মানুষকে বড় করাই সমাজের কাজ। সংসারে স্বল্পপ্রাণ, স্থূলবুদ্ধি ও জবরদস্তিপ্রিয় লোকই বেশি। তারা নিজ জীবনকে সার্থক ও সুন্দর করার পরিবর্তে কেবল অপরের চলার পথে, সার্থকতা ও কল্যাণের পথে বাধা সৃষ্টি করে। প্রেম ও সৌন্দর্যানুভূতিহীন বলে তারা নিষ্ঠুর ও বিকৃতবুদ্ধি। ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও জাতিগত অহংকারে তারা আচ্ছন্ন। কদাচিৎ প্রেমের কথা বললেও তা আন্তরিকতাশূন্য ও উপলব্ধিহীন বলে তার কোন মূল্য থাকে না। এদের পরিবর্তে সূক্ষ্মবুদ্ধি, উদার হৃদয় ও গভীরচিত্ত ব্যক্তিরই প্রয়োজন অধিক তাদের কাছে বিকাশই বড় হয়ে উঠবে, কেবল টিকে থাকা নয়।
লেখকের মতে,
তাদের জীবনের আদর্শ হবে সজীব বৃক্ষ বৃক্ষের বৃদ্ধি, গতি ও বিকাশ আছে; ফুলে-ফলে পরিপূর্ণতা নিয়ে সে অপরের সেবা করছে। বৃক্ষের জীবনের গতি ও বিকাশের মধ্যেই মানুষ তার সার্থকতা ও পরিপূর্ণতার ছবি লাভ করতে পারে ।
লেখকের মতে,
বৃক্ষের দিকে তাকালে জীবনের উপলব্ধি সহজ হয় এবং সেদিকে বারবার তাকানো প্রয়োজন। বৃক্ষ মাটি থেকে রস টেনে বৃদ্ধি পায়, ফুল ফুটিয়ে, ফল ধরিয়ে একটি সম্পূর্ণ জীবন সৃষ্টি করে। মানুষের জীবনেও সার্থকতা লাভের জন্য বৃক্ষের এ বৈশিষ্ট্য অনুসরণ করা উচিত ৷ কারণ, সজীবতা ও সার্থকতার এমন জীবন্ত দৃষ্টান্ত আর নেই।
রবীন্দ্রনাথ অবশ্য ফুল ফোটায় নয়, নদীর গতিতেই মনুষ্যত্বের সাদৃশ্য দেখতে পেয়েছেন। তাঁর মতে, মনুষ্যত্বের বেদনা নদীর গতিতেই উপলব্ধ হয়-ফুলের ফোটাতে নয়। ফুলের ফোটা সহজ, নদীর গতি সহজ নয় । তাছাড়া নদীর গতিতে মনুষ্যত্বের দুঃখ যতটা স্পষ্ট বৃক্ষের ফুল ফোটানোয় ততটা স্পষ্ট হয় না। এ বিষয়ে কবিগুরুর সাথে লেখক দ্বিমত পোষণ করেন। তাঁর মতে, চর্মচক্ষু ছাড়া কল্পনা ও অনুভূতিকে প্রাধান্য দিয়েও বৃক্ষের বেদনা সহজে উপলব্ধি করা যায়। বৃক্ষের সাধনায় ধীর স্থির ভাব আছে; মানুষের সাধনাও তদ্রূপ।
অনবরত ধেয়ে চলা মানুষের সাধনা হওয়া উচিত নয়। গোপন ও নীরব সাধনা বৃক্ষেই অভিব্যক্ত-নদীতে নয়। পক্ষান্তরে, বৃক্ষের সার্থকতার ছবি সহজেই উপলব্ধি করা যায়, নদীর সার্থকতার উপলব্ধি কষ্টকর। নদীর পরিণতি সাগরে আত্মবিসর্জন । আমাদের কাছে তা স্পষ্ট নয় ।
অপরপক্ষে বৃক্ষের সাধনা, সার্থকতা ও প্রাপ্তি আমাদের চোখের সামনেই ঘটে। আমাদের দুয়ারের কাছে দাঁড়িয়ে, আমাদের গোচরেই বৃক্ষ সর্বদা নতি, শান্তি ও সেবার বাণী প্রচার করছে। সাধনায় প্রাপ্তি একটা বড় জিনিস। বৃক্ষে সাধনার প্রাপ্তি ও দান দু-ই প্রতিভাত হয়। সৃজনশীল মানুষেরও প্রাপ্তি ও দানে পার্থক্য নেই। যা তার প্রাপ্তি তা-ই তার দান। কবিগুরু বৃক্ষের দিকে তাকিয়ে অন্তরের সৃষ্টি ধর্ম উপলব্ধি করেছেন ও কবিতায় তার পরিচয়ও আছে। কিন্তু গদ্যে তা তিনি স্পষ্ট করে বলেন নি। তাই লেখক বৃক্ষকেই মনুষ্য জীবনের আদর্শের প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করেছেন ।
‘নীরব ভাষায় বৃক্ষ আমাদের সার্থকতার গান গেয়ে শোনায়’। অনুভূতির কান দিয়ে তা উপলব্ধি করতে হয়। জীবনের মানে বৃদ্ধি, ধর্মের মানেও তাই । প্রকৃতিও মানুষের ধর্ম একই প্রকার।
তবে তরুলতা, জীবজন্তুর বৃদ্ধিতে তাদের কোন হাত নেই-কিন্তু মানুষের বৃদ্ধিতে তাদের হাত রয়েছে। মানুষ কেবল দৈহিক বৃদ্ধিই লাভ করে না, আত্মিক দিক থেকেও সে বৃদ্ধি পায়। এ আত্মা তাকে সৃষ্টি করতে হয়। সুখ-দুঃখ বেদনার উপলব্ধি ও সূক্ষ্ম চেতনার ফলে অন্তরের পরিপক্বতাই আত্মা। এ আত্মারূপ ফল স্রষ্টার উপভোগ্য। তাই বলা হয়, Ripeness is all- পরিপক্বতাই সব। ফলে, আত্মাকে মধুর ও বিকশিত করে তুলতে হবে। নইলে তা স্রষ্টার উপভোগের উপযুক্ত হবে না। বিচিত্র অভিজ্ঞতা, প্রচুর প্রেম, সীমাহীন ত্যাগ, সেবা ও গভীর অনুভূতি দ্বারাই আত্মার পরিপুষ্টি, মাধুর্য ও বিকাশ সম্ভব। এসব বিষয়ের সাধনাই মানুষের শিক্ষার বিষয়বস্তু।
আরো পড়ুন: বঙ্গভূমির প্রতি কবিতার ব্যাখ্যা,
বিজ্ঞান বা বস্তু-জিজ্ঞাসায় তা লভ্য নয়। বিজ্ঞান দ্বারা নয়, সাহিত্য- শিল্পকলায়ই আত্মার উন্নতি ঘটে, জীবনবোধ ও মূল্যবোধে অন্তর পরিপূর্ণ হয়। তাই লেখকের মতে, মনুষ্য জীবনের বিকাশের জন্য বৃক্ষের জীবন একটি চমৎকার নিদর্শন। বীজের অংকুরিত হওয়া থেকে বৃক্ষের ফুলবান ও ফলবান হওয়া পর্যন্ত বৃদ্ধির ইতিহাস। বৃক্ষের দিকে তাকালে আমরা লাভবান হতে পারি-জীবনের গূঢ় অর্থ সম্পর্কে সচেতন হতে পারি। বৃক্ষ শুধু বৃদ্ধির ইশারা নয়-প্রশান্তিরও ইঙ্গিত। তাই মনুষ্যজীবনের বিকাশের জন্য বৃক্ষকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা উচিত।
(সবচেয়ে আগে সব খবর, সঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ)